ভূমিহীন কৃষকের গান – হেলাল হাফিজ

দুই ইঞ্চি জায়গা হবে?

বহুদিন চাষাবাদ করিনা সুখের।

মাত্র ইঞ্চি দুই জমি চাই

এর বেশী কখনো চাবো না,
যুক্তিসঙ্গত এই জৈবনিক দাবি খুব বিজ্ঞানসম্মত
তবু ওটুকু পাবো না
এমন কী অপরাধ কখন করেছি!

ততোটা উর্বর আর সুমসৃণ না হলেও ক্ষতি নেই
ক্ষোভ নেই লাবন্যের পুষ্টিহীনতায়,
যাবতীয় সার ও সোহাগ দিয়ে
একনিষ্ঠ পরিচর্যা দিয়ে
যোগ্য করে নেবো তাকে কর্মিষ্ঠ কৃষকের মত।

একদিন দিন চলে যাবে মৌসুম ফুরাবে,
জরা আর খরায় পীড়িত খাঁ খাঁ
অকর্ষিত ওলো জমি
কেঁদে-কেটে কৃষক পাবে না।

অহংকার – হেলাল হাফিজ

বুকের সীমান্ত বন্ধ তুমিই করেছো
খুলে রেখেছিলাম অর্গল,
আমার যুগল চোখে ছিলো মানবিক খেলা
তুমি শুধু দেখেছো অনল।
 
তুমি এসেছিলে কাছে, দূরেও গিয়েছো যেচে
ফ্রিজ শটে স্থির হয়ে আছি,
তুমি দিয়েছিলে কথা, অপারগতার ব্যথা
সব কিছু বুকে নিয়ে বাঁচি।
 
উথাল পাথাল করে সব কিছু ছুঁয়ে যাই
কোনো কিছু ছোঁয় না আমাকে,
তোলপাড় নিজে তুলে নিদারুণ খেলাচ্ছলে
দিয়ে যাই বিজয় তোমাকে।

অভিমানের খেয়া – রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ

‘এতোদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই

পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত
পারিজাতহীন কঠিন পাথরে
প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে,
নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা_
এই খেলা আর কতোকাল আর কতোটা জীবন!
কিছুটা তো চাই- হোক ভুল হোক মিথ্যে প্রবোধ,
অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই
কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই।
আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন– আর কতোদিন?
ভাষাহীন তরু বিশ্বাসী ছায়া কতোটা বিলাবে?
কতো আর এই রক্ততিলকে তপ্ত প্রণাম!
জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারণাময়?
এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে,
এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে, কতোটা ক্ষরণ
কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়
তুমি জানো নাই– আমি তো জানি
কতোটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে, এতো গান, এতো হাসি নিয়ে বুকে
নিশ্চুপ হয়ে থাকি
বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন,
এইতো মাধুরী, এই তো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত।
তুমি জানো নাই– আমি তো জানি
মাটি খুঁড়ে কারা শষ্য তুলেছে,
মাংসের ঘরে আগুন পুষেছে
যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু,
করতলে তারা ধরে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার
পরাজয় এসে কণ্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা,
চিতার চাবুক মর্মে হেনেছো মোহন ঘাতক
তবুও তো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়,
পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু।
বৈশাখী মেঘ ঢেকেছে আকাশ
পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়–
ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ চোখ আর কতোদিন?
নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতোটা জীবন?
কতোটা জীবন?’
‘কিছুটা তো চাই– হোক ভুল হোক মিথ্যে প্রবোধ,
অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই
কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই…

প্রেমের কবিতা – মহাদেব সাহা

আমাদের সেই কথোপকথন, সেই বাক্যালাপগুলি
টেপ করে রাখলে
পৃথিবীর যে-কোনো গীতি কবিতার শ্রেষ্ঠ সংকলন
হতে পারতো; হয়তো আজ তার কিছুই মনে নেই
আমার মনে সেই বাক্যালাপগুলি নিরন্তর শিশির
হয়ে ঝরে পড়ে,
মৌমাছি হয়ে গুনগুন করে স্বর্ণচাঁপা আর গোলাপ
হয়ে ঝরতে থাকে;
সেই ফুলের গন্ধে, সেই মৌমাছির গুঞ্জনে
আর কোকিলের গানে
আমি সারারাত ঘুমাতে পারি না, নিঃশ্বাস ফেলতে
পারি না,
আমাদের সেই কথোপকথন, সেই বাক্যালাপগুলি
আমার বুকের মধ্যে
দক্ষিণ আমেরিকার সমস্ত সোনার খনির চেয়েও
বড়ো স্বর্ণখনি হয়ে আছে-
আমি জানি এই বাক্যালাপগুলি গ্রন্থিত করলে
পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা হতে পারতো;
সেইসব বাক্যালাপ একেকটি হীরকখণ্ড হয়ে আছে,
জলপ্রপাতের সঙ্গীত মূর্ছনা হয়ে আছে,
আকাশে বুকে অনন্ত জ্যোৎ্লারাত্রির
স্নিগ্ধতা হয়ে আছে;
এই বাক্যালাপের কোনো কোনো অংশ কোকিল
হয়ে গেয়ে ওঠে,
কেনো কোনো অংশ
ঝর্না হয়ে নেচে বেড়ায়
আমি ঘুমাতে পারি না, জেগে থাকতেও পারি না,
সেই একেকটি তুচ্ছ শব্দ আমাকে কেন যে এমন
ব্যাকুল করে তোলে, আপাদমস্তক আমকে বিহ্বল,
উদাসীন, আলুথালু করে
তোলে;
এই কথোপকথন, এই বাক্যালাপগুলি হয়তো পাখির
বুকের মধ্যে টেপ করা আছে,
নদীর কলধ্বনির মধ্যে ধরে রাখা আছে এর
চেয়ে ভালো প্রেমের কবিতা আর কী লেখা হবে!

চোখে এখন আর জল আসেনা-রেদোয়ান মাসুদ

চোখে এখন আর জল আসেনা
কত কাদি, কত একা বসে থাকি
কিন্তু কান্নার আর শেষ হয় না
কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে গেছে জলের রাশি
তাইতো এখন আর রোমাল দিয়ে চোখ মুছতে হয় না।।

তোমাকে হারানোর কথা এখন আর মনে করতে হয় না
চোখের সামনে সবসময়ই ভাসে তোমার ছবি
যে ছবি এখন আর রং তুলি দিয়ে আকতে হয় না
হৃদয়ের ঝরানো সে রক্ত দিয়ে আকা
তাই শুধু শুধু এখন আর কাগজ তুলি নিয়ে বসে থাকতে হয় না।।

গাছের ডালে এখন আর পাখি ডাকে না
পৌষ মাসেও পাতার ডগায় নিশি জমে না
নদীর বুকে এখন মরুভূমি বাসা বেধেছে
যা তোমার সাথে এখন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে
তাইতো নদীর সেই কলকল সূর এখন আর কানে আসেনা।।

শত চেষ্টার পরেও এখন আর গান শুনতে পারি না।
কারন বনের পাখি এখন আর গান গায় না
ফুলের বাগানেও এখন আর গন্ধ পাই না
ভোমরাও নাকি তাই এখন আর ফুলের বাগানে আসে না
তাইতো নাক কান এখন আর খোলা রাখতে হয় না।।

সাগরে নাকি এখন অনেক ঢেউ ওঠে
কিন্তু সেই ঢেউ এখন আর হৃদয়ে দোলা দেয় না
কারন আকাশে এখন অনেক মেঘ জমে আছে
আর সেই মেঘ পৃথিবীটাকে অন্ধকার করে রেখেছে
তাইতো হৃদয়ে এখন আর বৃষ্টির ছোয়া লাগে না।।

চোখের পাতা এখন আর বুজাতে হয় না
সারাক্ষন চেয়ে থাকে
এখন আর বার বার বলতে হয় না
আর একটু জেগে থাক, একটু পরে ঘুমাও
এভাবেই জেগে থাকি।।

কারো সামনে এখন আর কান্না লুকাতে হয় না
ভিতরে কষ্ট থাকলেও বাইরে দেখা যায় না
কি হয়েছে তোর? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না
কারন, চোখে এখন আর জল আসেনা
তাইতো রোমাল দিয়ে এখন আর চোখ মুছতে হয় না।।